নিজস্ব প্রতিবেদক
ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৫ই আগস্ট হাসিনার নাটকীয়ভাবে ক্ষমতা হারানোর পর তিনি একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান।
শেখ হাসিনা দিল্লিতে অবতরণের পর গণমাধ্যমের বিভিন্ন খবরে বলা হয়েছিল হাসিনা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে আশ্রয়ের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দেশগুলো সাফ জানিয়ে দিয়েছে তাদের দেশে হাসিনার জায়গা হবেনা। এই পরিস্থিতিতে তার সামনে অপশন মাত্র দুটো। হয়ত তিনি ভারতেই রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে থাকবেন, নাহয় তাকে দেশে ফিরে আসতে হবে। এখানে দেখার বিষয় ভারত হাসিনার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয়। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, যদি হাসিনা স্থায়ীভাবে ভারতে অবস্থানের সুযোগ পান তাহলে তা দিল্লিকে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সাথে সম্পর্ক গড়তে চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।
কেননা ভারতের কাছে বাংলাদেশ শুধুমাত্র প্রতিবেশী দেশই নয়। দিল্লির কৌশলগত অংশীদার হচ্ছে বাংলাদেশ। এছাড়া ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘনিষ্ঠ মিত্র হচ্ছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে ভারতের জন্য বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনলাইন বিবিসির এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
এতে বলা হয়, দুই দেশের মোট সীমান্ত ৪ হাজার ৯৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে যদি কখনও বিদ্রোহ দেখা দেয় তাহলে তা বাংলাদেশের সাহায্য ছাড়া মোকাবিলা করা দিল্লির জন্য কঠিন। কেননা রাজ্যগুলোর গোষ্ঠীগুলো নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করা তুলনামূলকভাবে সহজ। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জাতিগত বিদ্রোহীদের দমন করতে ভারতের তেমন বেগ পোহাতে হয়নি। কেননা হাসিনা ভারতের সাথে বেশ কয়েকটি সীমান্ত বিরোধও বন্ধুত্বপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি করেছিলেন। সীমান্ত নিরাপত্তা মূলে থাকলেও আর্থিক দিকও এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্কের বিকাশ ঘটে। ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলিতে পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের সড়ক, নদী এবং রেল পথ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে। ২০১০ সাল থেকে ভারত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশকে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ দিয়েছে। তবে হাসিনার এমন আকস্মিক ক্ষমতা হারানোয় পুনরায় বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা দিল্লির জন্য বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে।
ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন,‘এটি এই অর্থে একটি ধাক্কা যে আমাদের আশেপাশে যেকোনো অশান্তি সবসময়ই অবাঞ্ছিত।’ তবে সাবেক এই কূটনীতিক জোর দিয়েছিলেন যে, দিল্লি ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে কাজ করবে। কেননা এর কোন বিকল্প নেই এবং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণভাবে যা করবে তা ভারত নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করতে সময় ক্ষেপণ করেনি।
হাসিনার পতনের মধ্য দিয়ে এটি স্পষ্ট বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নিকটবর্তী সময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা নেই। এক্ষেত্রে ভারত যদি আওয়ামী লীগের বিকল্প কাউকে তাদের কাছে টানতে না পারে তাহলে তাদের জন্য বিষয়টি খুব জটিলই বটে। বাংলাদেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলটির এক নেতা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার যদি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারে তাহলে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বিএনপির সাথে ভারতের সম্পর্ক কতটা জোরালো। যেহেতু অতীতে তাদের সুসম্পর্কের কোনো নজির নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশে নিজেদের সম্পর্ক জোরালো করতে চীনও বেশ জোরালো উপস্থিতি জানান দেয়ার চেষ্টা করছে। কেননা ভারতের সাথে আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াইয়ে বেইজিং বাংলাদেশে তার পদচিহ্ন প্রসারিত করতে আগ্রহী। নির্বাচনে জয়ের পর মুইজ্জুর জন্য চীন লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছিল। সুতরাং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একই পরিণতি এড়াতে চাইবে দিল্লি। ভারতীয় পণ্য ও বাণিজ্যের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা ও কূটনৈতিক কৌশল তৈরি করার চেষ্টা করবে।
এক্ষেত্রে ভারতে হাসিনার উপস্থিতি ঘিরে দিল্লিকে সাবধানে পা ফেলতে হবে। বিশেষ করে যদি অন্তর্বর্তী সরকার হাসিনাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত দেয়ার অনুরোধ করে। এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা হচ্ছে ভারত কোনোভাবেই হাসিনাকে ফেরত দিতে চাইবে না। অন্যদিকে অনেকের মনেই একটি প্রশ্ন হচ্ছে, হাসিনা কী ভারত থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। এ বিষয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ভারত হাসিনাকে কীভাবে আতিথেয়তা করবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু ভারতে থেকে হাসিনার ঘরোয়া রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা শত্রুতাকে উস্কে দেবে। এতে হাসিনা ও দিল্লি উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।