উজ্জ্বল কুমার সরকার:
আজ ১৯ জানুয়ারি দার্শনিক ও সমাজসেবক মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এর প্রয়াণ দিবস। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই মে (৩রা জ্যৈষ্ঠ ১২২৪ বঙ্গাব্দ) তারিখে কলকাতার জোড়াসাঁকোস্থ ঠাকুর বাড়ীতে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দ্বারকনাথ ঠাকুর এবং মাতার নাম ছিল দিগম্বরী দেবী।
১৮২৭ সালে ইনি দ্বারকনাথের প্রতিষ্ঠিত এ্যাংলো-হিন্দু স্কুলে ভর্তি হন। সম্ভবতঃ এই স্কুলে ইনি ১৮৩০ সাল পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। এই স্কুলে পড়ার সময়– স্কুলের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রদের নিয়ে ‘সর্বতত্ত্বদীপিকা’ নামে একটি সভা স্থাপিত হয়েছিল। ইনি এই সভার সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
উল্লেখ্য এই সভাতে নির্ধারিত হয়েছিল যে,– সভার সদস্যগণ কেউই বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলবেন না।১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ইনি এই স্কুল ছেড়ে দ্বারকানাথের প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের কোষাধ্যক্ষ রমানাথ ঠাকুরের অধীনে শিক্ষানবীশ হিসাবে যোগদান করেন। এই সময় ইনি নানা প্রকার আমোদ-প্রমোদের মধ্য অতিবাহিত করেন। ফলে তাঁর অভিভাবকরা তাঁর বিবাহের ব্যবস্থা করেন। ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে যশোহরের রামনারায়ণ চৌধুরীর কন্যা সারদাসুন্দরী দেবীর সাথে তাঁর বিবাহ হয়। ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে এঁর পিতামহী অলকা দেবীর মৃত্যুর পর এঁর জীবনধারা পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই সময় ইনি ভারতীয় ও ইউরোপীয় ধর্ম ও দর্শনপাঠে আত্মনিয়োগ করেন।
এরপর তিনি সকল ধর্মীয় গ্রন্থের মধ্য থেকে উপনিষদকে সঠিক গ্রন্থ হিসাবে নির্বাচিত করেন। মূলতঃ উপনিষদের চর্চা ও এর বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে ইনি ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই অক্টোবর (২১ই আশ্বিন ১২৪৬ বঙ্গাব্দ) তারিখে জোড়সাঁকোর-বাড়ির একটি ছোটো ঘরে দশজন আত্মীয় ও বন্ধু নিয়ে ‘তত্ত্বরঞ্জিনী সভা’ স্থাপন করেন। এই সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ সভার আচার্য পদ গ্রহণ করলে– আচার্য এই নাম পরিবর্তন করে রাখেন– ‘তত্ত্ববোধিনী’।
১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে ইনি ‘তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা’ স্থাপন করেন। এই স্কুলটি সেখানে জনসমাদর লাভ না করায় স্কুলটি বাঁশবেড়িয়া নামক গ্রামে স্থানান্তরিত করেন এবং শেষ পর্যন্ত দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজা রামমোহন রায় একেশ্বরের উপাসনার জন্য ‘আত্মীয়সভা’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কালক্রমে তাই ব্রাহ্মধর্মে রূপলাভ করে। দ্বারকানাথ যতদিন জীবিত ছিলেন, ইনি ততদিন এই সমাজকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে গেছেন। রামামোহন রায় ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে বিলেত গেলে এবং দ্বারকানাথের মৃত্যু হলে– দেবেন্দ্রেনাথ এই সমাজের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন।
এই সময় ইনি এই ধর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্য ১৮৪২ সালে (বৈশাখ ১৭৬৪ শকাব্দ) তত্ত্ববোধনী সভা’র পরিচালনাভার গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মসমাজের বক্তব্য প্রচারের জন্য ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ডিসেম্বর ‘তত্ত্ববোধিনী’ নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ইনি ২১ জন আত্মীয়-সহ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর অবশিষ্ট আত্মীয়রা এই সময় তাঁকে পরিত্যাগ করেন।দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর তাঁর বহু ঋণ দেবেন্দ্রনাথের কাঁধে এসে পড়ে। এই সময় বাড়িতে অন্যান্য জ্ঞাতিবর্গ প্রতিমা পূজা চালু রেখেছিলেন। সে কারণে দুর্গাপূজা’র সময় ইনি দেশ ভ্রমণে বের হতেন। উল্লেখ্য সে সময় তাঁর সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন তাঁর অপর ভাই গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে গিরীন্দ্রনাথের মত্যু হলে ইনি সম্পত্তি পরিচালনার দায়িত্ব নেন। ১৮৫৯ সালে ইনি কলকাতায় ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করেন। এর কিছুদিন পর ব্রাহ্মসমাজের গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম কেশবচন্দ্রের হাতে ন্যাস্ত করেন। পরে ধর্মীয় আদর্শের কারণে কেশবচন্দ্রের সাথে সংঘাত উপস্থিত হলে –ব্রাহ্মসমাজ বিভক্ত হয়। কেশবচন্দ্রের অনুগামী ধর্মের নাম ছিল ‘ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ’, পক্ষান্তরে দেবেন্দ্রনাথের অনুগামী ধর্মের নাম হলো- ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’।
এরপর তিনি ধীরে ধীরে সকল বৈষয়িক ও ধর্মীয় সংঘাত থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন।তিনি ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি (৬ই মাঘ ১৩১১ বঙ্গাব্দ) তারিখে ৮৮ বৎসর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে জানাই গভীর শ্রদ্ধা। নওগাঁ।