নিজস্ব প্রতিবেদক
ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ন বাড়ছে। জানা গেছে, গতকাল বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত এ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে ৫ হাজার ৪ জন। চলতি মাসে গত ১২ দিনে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২০ জনের। আগস্টে এই সংখ্যা ছিল ২৭ জন। সব মিলিয়ে এ বছর দেশে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু হয়েছে ১০৩ জনের। আর মোট রোগীর সংখ্যা ১৭ হাজার ৮৪৫ জন। আর গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬১ জন। মারা গেছেন ১ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে অক্টোবরে ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে ডেঙ্গুর প্রকোপ। বিশেষ করে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ১৮টি জেলার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬১ জন। মারা গেছেন ১ জন।
এবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি বিষয়কে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হলো স্থানীয় পর্যায়ে ঠিকমতো মশকনিধন না করা, গণ-আন্দোলনে সময় সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিসে হামলায় মশা মারার মেশিন নষ্ট হওয়া, পরিবর্তিত অবস্থায় প্রশাসনের ঠিকমতো গুছিয়ে না উঠতে পারার খেসারত দিতে হচ্ছে নগরবাসীকে। এদিকে মেয়র না থাকায় নতুন করে দায়িত্ব নিয়েছেন প্রশাসকেরা। অল্প সময়ের মধ্যে তাদের প্রস্তুতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল। ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে ওই বছর। তার আগের বছর ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৮৬৮ জন। চলতি বছর মৃত্যু ও আক্রান্তের হার এখন পর্যন্ত কম। তবে কিছুদিন ধরে হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে ৩৯৬ জন মৃত্যুবরণ করেছিল। অক্টোবরে এই সংখ্যা ছিল ৩৫৯ জন।
তবে চলতি বছর এই সংখ্যা অনেক কম। বর্তমানে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৫৩ শতাংশ ঢাকা মহানগরে এবং ৪৭ শতাংশ ঢাকার বাইরে। মৃতদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ ঢাকার এবং ৩৩ শতাংশ ঢাকার বাইরে।
চলতি বছর এপ্রিলে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয় ২ জনের, মে মাসে মৃত্যু হয় ১২ জনের, জুনে মৃত্যু হয় ৮ জনের, জুলাই মাসে মৃত্যু ১২ জনের। এবার ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। এ এলাকায় ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ হতে মশকনিধন কার্যক্রম তদারকি করার জন্য কমিটি করা হয়েছে। তদারকির জন্য বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ১০টি অঞ্চলে ১০টি দল গঠন করা হয়েছে। আর দক্ষিণ সিটি (ডিএসসিসি) থেকে মশকনিধন কার্যক্রমের জন্য সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে অনলাইনের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণের কথা বলা হয়েছে। যাঁরা বিভিন্ন এলাকায় মশা মারার কাজ করছেন, তাঁদের শরীরে ডিভাইস যুক্ত করা আছে। এর মাধ্যমে এসব কর্মীর গতিবিধি লক্ষ করা যাচ্ছে।
সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, আগস্ট মাসে সহিংসতায় ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২৫টি ওয়ার্ডের মশকনিধনের যন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত বা চুরি হয়েছে। উত্তর সিটিতে ১৫টি ওয়ার্ডের মশকনিধনের সরঞ্জাম কমবেশি নষ্ট হয়েছে। তারপরও নগর কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তাদের কাজ চলছে।
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, ‘তাঁরা ডেঙ্গুর বিষয়ে যে পরিকল্পনা আছে, সেই অনুযায়ী কাজ করছেন। কাউন্সিলর না থাকার কারণে একটু সমস্যা হয়েছে। এ জন্য টিম করা হয়েছে। তবে আগে থেকেই বলা হয়েছিল ডেঙ্গু বাড়বে আর সেটা জলবায়ুগত কারণে।
আর ডিএসসিসির প্রশাসক ড. মহা. শের আলী বলেন, দক্ষিণ সিটির আওতায় হাসপাতালে যেসব রোগী মারা যাচ্ছে, এগুলো এই করপোরেশনের বলা হচ্ছে। তবে তাঁরা হাসপাতাল ঘুরে দেখেছেন যে অনেক রোগী ঢাকারে বাইরের। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এই প্রশাসক বলেন, তাঁদের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। আশা করা হচ্ছে, ডেঙ্গুর যে ভয়াবহতার কথা বলা হচ্ছে, তেমন হবে না।
কিন্তু রাজধানীর রামপুরা, মগবাজার, মালিবাগ, কাকরাইল, তেজগাঁও, বাড্ডা এলাকায় ঘুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের এলাকায় মশকনিধন কার্যক্রম গত দুই মাসে খুব বেশি চোখে পড়েনি। রামপুরা মহানগর প্রকল্প এলাকার চা বিক্রেতা মো. কবির বলেন, ‘শেষ কবে মহানগর, বাগিচারটেকে মশা মারতে লোক আসছে, মনে নাই। ১৫ দিন ধরে মশার উৎপাত বাড়ছে। ভোররাতে মশা বেশি কামড়ায়।’ সরকার পতনের পর কাউকেই মশা মারতে দেখেননি বলে জানান তিনি।
পূর্ব রামপুরার পুরাতন পুলিশ ফাঁড়ি এলাকার বাসিন্দা আব্দুল বাসেদ ১০ দিন আগে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এখন অনেকটা সুস্থ। বাসেদ অভিযোগ করেন, তাঁর এলাকায় মশার মারার কোনো কার্যক্রম নেই।
এদিকে বর্ষা মৌসুম শেষ হলেই ডেঙ্গু ভয়ংকর রূপ নিতে পারে—এমন আগাম সতর্কবার্তা আগেই জানিয়েছিলেন কীটতত্ত্ববিদেরা। এ ব্যাপারে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. কবিরুল বাশার বলেন, দুই মাস আগে থেকেই তিনি ফরকাস্টিং মডেল করে জানিয়েছেন যে সেপ্টেম্বর মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ হবে। কেউ আমলে নেয়নি। গবেষকদের কথা কেউ কখনো আমলে নেয় না।
ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়বে জানিয়ে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। বান্দরবান, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, বরিশাল, বরগুনা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, খুলনা, যশোর, নড়াইল, মেহেরপুর, ঢাকার পাশের ময়মনসিংহ, মাদারীপুর, মানিকগঞ্জে পরিস্থিতি খারাপ হবে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কারণে ওই এলাকায় সংক্রমের হার বেশি, যা পুরো চট্টগ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে।