নিজস্ব প্রতিবেদক
জাহেলি বা জাহেলিয়্যাহ শব্দ আরবি ‘জাহলুন’ থেকে এসেছে। এর অর্থ মূর্খতাসুলভ। আর আইয়্যামে জাহেলিয়্যা বা জাহেলি যুগ মানে অন্ধকার সময়।
আরব ভূখণ্ডে যে সর্বগ্রাসী অন্ধকার ছিল, তার অনুরূপ অন্ধকার সমকালীন অন্য সমাজেও দৃষ্টিগোচর হয়। যদিও পার্থিব উন্নতি ও অগ্রগতি বিচারে ভারতীয়, পারসিক, রোম ইত্যাদি সভ্যতাগুলো এগিয়ে গিয়েছিল।
আরব ঐতিহাসিকদের মতে, ঈসা (আ.)-এর ওফাতের পর থেকে ইসলামের আবির্ভাব পর্যন্ত সময়কে জাহেলি যুগ বলা হয়। পি কে হিট্রি, ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী এক শতাব্দী কালকে জাহেলি যুগ বলে উল্লেখ করেছেন।
সিরাত গবেষক আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরি (রহ.) লিখেছেন, জাহেলি যুগে আরবসমাজের সামাজিক অবস্থার সারকথা বলতে গেলে শুধু এটুকু বলতে হয় যে স্থিরতা ও কূপমণ্ডূকতাই সমাজজীবনের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। অজ্ঞতা, অশ্লীলতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল গোটা সমাজ। অসত্য ও অন্যায়ের কাছে সত্য ও ন্যায় হয়ে পড়েছিল সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত। সাধারণ মানুষকে জীবন যাপন করতে হতো পশুর মতো।
বাজারের পণ্যের মতো ক্রয়-বিক্রয় করা হতো নারীদের এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের সঙ্গে ব্যবহার করা হতো মাটি ও পাথরের মতো। গোত্র কিংবা রাষ্ট্র যাই বলা হোক না কেন, প্রশাসনের মূল ভিত্তি ছিল শক্তিমত্ততা। প্রশাসন পরিচালিত হতো শক্তিধরদের স্বার্থে। দুর্বল শ্রেণির সাধারণ লোকজনের কল্যাণের কথা কস্মিনকালেও চিন্তা করা হতো না। প্রজাদের কাছ থেকে গৃহীত অর্থ-সম্পদে কোষাগার ভরে তোলা হতো এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে সৈন্য দলের মহড়া ও যুদ্ধবিগ্রহের উদ্দেশ্যে তা সংরক্ষিত হতো।
(আর-রাহিকুল মাখতুম)
পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত থেকে জাহেলি যুগের ভয়াবহতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা ছিলে অগ্নিকুণ্ডের প্রান্তে, আল্লাহ তা থেকে তোমাদের রক্ষা করেছেন…।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)
পবিত্র কোরআনে জাহেলিয়্যাহ শব্দ চারবার ব্যবহার করা হয়েছে। এবং এর মাধ্যমে জাহেলি যুগের চারটি মৌলিক অপরাধের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমন—
১. বিশুদ্ধ বিশ্বাসের অনুপস্থিতি, স্রষ্টা সম্পর্কে মন্দ ধারণা, আল্লাহর সঙ্গে বন্ধন হালকা হওয়া, সত্যবিমুখতা ইত্যাদি জাহেলি যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারপর তিনি (আল্লাহ) তোমাদের ওপর (ওহুদ যুদ্ধের দিন) দুশ্চিন্তার পর নাজিল করলেন প্রশান্ত তন্দ্রা, যা তোমাদের মধ্যে থেকে এক দলকে ঢেকে ফেলেছিল, আর অন্য দল নিজরাই নিজদের চিন্তাগ্রস্ত করেছিল। তারা আল্লাহ সম্পর্কে জাহেলি ধারণার মতো অসত্য ধারণা পোষণ করছিল। তারা বলছিল, আমাদের কি কোনো বিষয়ে অধিকার আছে? বলো, নিশ্চয়ই সব বিষয় আল্লাহর। তারা তাদের অন্তরে লুকিয়ে রাখে এমন বিষয়, যা তোমার কাছে প্রকাশ করে না…।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৪)
২. জুলুমপূর্ণ সামাজিক কাঠামো ও মনগড়া রাষ্ট্রীয় আইন, আল্লাহর আইনবিরোধী শাসন ও বিধান এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যপূর্ণ নিয়ম-নীতি জাহেলি যুগের অন্যতম অনুষঙ্গ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি তবে জাহেলিয়্যাতের বিধান চায়? আর নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান প্রদানে আল্লাহর চেয়ে কে বেশি উত্তম?’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৫০)
৩. সমাজে ব্যাপকহারে অশ্লীলতার প্রসার, নারীদের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তাহীনতা এবং অধিকার বঞ্চিত হওয়া জাহেলি সমাজের নিত্যচিত্র। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা নিজ গৃহে অবস্থান করবে এবং প্রাক-জাহেলি যুগের মতো সৌন্দর্য প্রদর্শন কোরো না…।’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩৩)
৪. গোত্রপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি, সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি ও জাতীয়তাবাদে আত্মমুগ্ধতা জাহেলি যুগের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন কাফিররা তাদের অন্তরে আত্ম-অহমিকা পোষণ করেছিল, জাহেলি যুগের আহমিকা…।’ (সুরা : ফাতহ, আয়াত : ২৬)
মহান আল্লাহ আমাদের জাহেলি স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য থেকে হেফাজত করুন।