নিজস্ব প্রতিবেদক
শিশু অধিকারের সুরক্ষায় বিশ্বজুড়ে কাজ করছে ওয়ার্ল্ড ভিশন। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া শিশুদের উন্নয়নে শিশু ফোরাম গঠনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ (UNCRC) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দিনাজপুর সদর উপজেলার ৪৭টি গ্রাম পর্যায়ের শিশু ফোরাম, ৫টি পিএফএ (প্রাইমারি ফোকাস এফোর্ট), এবং ১টি এপি (অ্যাডভান্সড প্রোগ্রাম) ভিত্তিক ফোরাম গঠন করা হয়েছে, যা এই শিশুদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়নের দিকে দৃষ্টি রাখছে। এসব ফোরামে সাবেক সদস্যরা, যারা বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং ওয়ার্ল্ড ভিশনের বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত আছেন, নিয়মিত সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত থেকে অসহায় শিশুদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা যা মহান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে বাংলাদেশে শিশুদের সামগ্রিক বিকাশের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। সংস্থাটি বর্তমানে ২৯টি জেলার ৫৫টি আঞ্চলিক কর্মসূচির মাধ্যমে প্রায় ১ কোটি ৪৪ লক্ষ দরিদ্র ও হতদরিদ্র শিশুকে উন্নয়ন ও সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। এর কার্যক্রমে রয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, শিশু নিরাপত্তা, জীবিকা উন্নয়ন, কিশোর-কিশোরীদের বিকাশ ও নেতৃত্ব গঠন এবং দুর্যোগকালীন ত্রাণ কার্যক্রম।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ শিশু ফোরাম গঠন করেছে শিশুদের অধিকার রক্ষা এবং তাদের সঠিক বিকাশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। বর্তমানে সাংগঠনিক নেতৃত্ব ও সুনাগরিকত্ব গড়ার লক্ষ্যে এক লক্ষ আটাত্তর হাজার কিশোর-কিশোরী ও যুব সদস্য/ সদস্যাদের নিয়ে কাজ করছে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ। জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, প্রত্যেক শিশুর অধিকার রয়েছে সুরক্ষা, শিক্ষা, এবং সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার। কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা প্রায়ই এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এজন্য ওয়ার্ল্ড ভিশন তাদের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে।
ফোরামের সদস্যদের জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ এবং শিশু অধিকার সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় যেমন শিশুশ্রম প্রতিরোধ, বাল্যবিবাহ বন্ধ, শিশু সুরক্ষা, এবং শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে নিয়মিত ট্রেনিং ও ওরিয়েন্টেশন দেওয়া হচ্ছে। এই কার্যক্রমগুলো শিশুদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করছে এবং তাদেরকে সমাজের উন্নয়নে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে গড়ে তুলছে।
শিশু ফোরামগুলোর প্রধান কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এলাকায় মাদকবিরোধী বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ এবং শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্থানীয় দায়িত্ব বাহকদের সাথে যোগাযোগ করে পদক্ষেপ নেয়া, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালন করা,দরিদ্র ও হতদরিদ্র শিশুদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ, শীতবস্ত্র প্রদান, ঝরে পড়া শিশুদের স্কুলমুখী করা এবং দরিদ্র পরিবারের মাঝে ঈদ সামগ্রী বিতরণ। এছাড়াও, বৃক্ষরোপণ এবং শিশুদের শতভাগ জন্ম নিবন্ধন নিশ্চিত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্ব পালন করছে ফোরামগুলো। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাদের বিনামূল্যে পরিচালিত পাঠদান কেন্দ্র, যা গ্রামের শিশুদের জন্য একটি আলোকিত ভবিষ্যতের দুয়ার খুলে দিয়েছে।
ফোরামের সদস্যরা নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সামাজিক সচেতনতা কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন, যেমন পরিবেশ সংরক্ষণে বৃক্ষরোপণ, শিশু অধিকার বিষয়ে ক্যাম্পেইন পরিচালনা, এবং শিশু সুরক্ষা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি। গত এক বছরে ৫০-৫৫টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা হয়েছে, এবং মেয়েদের সহ তাদের পরিবারকে বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন করা হয়েছে। দিনাজপুর এপি শিশু ফোরামের লিডার ও জাতীয় শিশু ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নিলয় দেবনাথ এবং আয়েশা সিদ্দিকা জাতীয় শিশু ও যুব এডভাইসারি কাউন্সিলের পুষ্টি বিষয়ক সম্পাদকের নেতৃত্বে দিনাজপুরে সাংগঠনিক কাজ পরিচালিত হচ্ছে।
সাফল্যের পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, যার মধ্যে তহবিলের সংকট, সঠিক তথ্য সংগ্রহের জটিলতা, এবং অভিভাবকদের পক্ষ থেকে বাধার সম্মুখীন হওয়া উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও, সদস্যদের উপস্থিতি নিশ্চিত করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে স্থানীয় প্রশাসন এবং কমিউনিটির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ শিশু ফোরামের কার্যক্রমকে আরও সুসংহত ও বিস্তৃত করার লক্ষ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিটি শিশু ফোরামের প্রোফাইল তৈরি, সাফল্যের ভিত্তিতে কেইস স্টাডি প্রকাশ, এবং শিশু একাডেমি সহ সরকারি বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ।সাবেক শিশু ফোরামের সদস্যরা যুব ফোরামের নিবন্ধনের প্রক্রিয়া শেষ করেছে। উপজেলা শিশু সুরক্ষা কমিটি, শিশু কল্যান বোর্ডকে সক্রিয় করার জন্য উপজেলা প্রশাসনের সাথে মতবিনিময় করছে, গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুদের তালিকা তৈরি, জলবায়ু, শিশুদের নিয়ে কাজ করে এমন এনজিও দের সাথে সেতুবন্ধন, মেডিক্যাল ক্যাম্প, জীবন দক্ষতা ভিত্তিক প্রশিক্ষণ। এছাড়াও, উপজেলায় শিশু সুরক্ষা বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে আলোচনা, শতভাগ জন্ম নিবন্ধন নিশ্চিত করা, এবং বাল্যবিবাহ মুক্ত গ্রাম গঠনে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
শিশু ফোরামের সদস্যদের জন্য ইংরেজি শেখার সুযোগ তৈরি করাও তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির একটি উল্লেখযোগ্য দিক।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের এই উদ্যোগগুলো শিশুদের জীবনে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে। এই ফোরামগুলো শুধুমাত্র শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করছে না, বরং তাদেরকে সমাজের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করছে। বিশ্বব্যাপী শিশুদের সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য ওয়ার্ল্ড ভিশনের এই ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের শিশু অধিকার সুরক্ষায় মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। সাবেক শিশু ফোরাম নেতা, মেহেদী হাসান মুরাদ বলেন, “আমি নিজেও একসময় রংপুর বিভাগীয় শিশু ফোরামের নেতৃত্ব দিয়েছি। শিশু ফোরামের থাকাকালীন ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের পৃষ্ঠপোষকতায় শিশুদের উন্নয়নের দূত হিসেবে কাজ করেছি। এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নেতৃত্ব দিচ্ছি। শিশু ফোরামের এই সাফল্য দেখে আমি গর্বিত। আমি বিশ্বাস করি, এই শিশু ও যুবারাই আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণ করবে।
মেহেদী হাসানের মতো নেতৃবৃন্দের কথা শিশু ফোরামের গুরুত্ব ও কার্যক্রমের সাফল্যকে আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। শিশু ফোরামের মাধ্যমে তৈরি হওয়া দক্ষ ও দায়িত্বশীল নেতারা শুধু তাদের কমিউনিটিতেই নয়, বরং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের এই ধরনের কার্যক্রম ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে তৈরি করতে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।