মো: খোরশেদ আলম, নিজস্ব প্রতিবেদক:
জামালপুর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস-২০২৪ উপলক্ষে বর্ণাঢ্য র্যালী পরবর্তী আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
উক্ত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন জামালপুর জেলার সুযোগ্য জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব হাসিনা বেগম।
উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন জামালপুর জেলার অতিরিক্ত সুযোগ্য জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো: সাইফুল ইসলাম, জামালপুর জেলা সমাজ সেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো: রোকোনুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক আবু ইলিয়াস মল্লিক, উন্নয়ন সংঘের পরিচালক ও মানবাধিকার কর্মী মো: জাহাঙ্গীর সেলিম, শহর সমাজ সেবা অফিসার ফারুক মিয়া, জামালপুর সদর উপজেলার সমাজ সেবা অফিসার মো: শাহাদাৎ হোসেন, তরঙ্গ মহিলা কল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক শামীমা খান, এসএ টেলিভিশন এর সাংবাদিক ফজলে এলাহী মাকাম, প্রবীণ, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, সূর্য তোরণ সমাজ সেবা সংস্থা এর ফিল্ড সুপারভাইজার ও গণমাধ্যম কর্মী মো: এমদাদুল হক প্রমুখ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন এনজিও প্রতিনিধি, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন কর্মকর্তাগন।
বক্তারা বলেন বার্ধক্য ও প্রবীণ একই অর্থে ব্যবহৃত হলেও বাস্তবে দুয়ের মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা আছে। সাধারণভাবে ‘প্রবীণ’ বলতে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের বোঝায়, যারা বার্ধক্যে উপনীত হয়েছেন। যারা আমাদেরই অতি আপনজন তথা দাদা-দাদি, নানা-নানি, পিতা-মাতা ইত্যাদি। আবার পেশাজীবী অনেকেই আজ প্রবীণ যেমন- শিক্ষক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, কৃষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী প্রমুখ। প্রবীণেরাই আধুনিক সমাজের রূপকার এবং সমাজের শ্রদ্ধেয় গুরুজন। ‘বার্ধক্য’ হচ্ছে জীবনচক্রের সর্বশেষ ও অবশ্যম্ভাবী অবস্থা। এটি জীবনচক্রের আবশ্যিক ও জৈবিক বাস্তবতাও বটে। বার্ধক্যের একটা নিজস্ব গতি রয়েছে এবং এর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা মানুষের নেই। অন্যদিকে বয়স হচ্ছে ব্যক্তির প্রবীণতা নির্ধারণের একমাত্র মানদণ্ড। জাতিসংঘ ঘোষণা ও প্রবীণবিষয়ক জাতীয় নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশের ৬০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তিকে প্রবীণ বলে অভিহিত করা হয়। বার্ধক্যের আঘাত সর্বজনীন ও জীবনের এক নাজুক অবস্থা। এ অবস্থায় মানুষের শারীরিক ও মানসিক কর্মক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকে।
বর্তমান সমাজে প্রবীণেরা সর্বাধিক অবহেলার শিকার। সন্তানদের মধ্যে আদর্শিক শিক্ষা, মূল্যবোধগত সংশয় ও ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবে দেশের বৃদ্ধ পিতা-মাতা কত যে অসহায় জীবন যাপন করছেন, তা উপলব্ধি করা যায় না। দেশের প্রবীণ সমাজ আত্মসম্মানবোধের কারণে নিজ অপমান ও অসহায়ত্বের কথা অতিসচেতনভাবে গোপন রাখছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে বর্তমানে প্রতি ছয়জনে একজন প্রবীণ নির্যাতনের শিকার, যার সংখ্যা ১৪ কোটির বেশি। তা ছাড়া বার্ধক্যে পৌঁছানোর পর প্রবীণরা বিবিধ রোগে আক্রান্ত হন। যেমন- ক্ষুধামান্দ্য, অনিদ্রা, ওজন হ্রাস, শারীরিক দুর্বলতা, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য, বিষণ্নতা, স্মৃতিভ্রষ্টতা, পড়ে যাওয়া, প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা, চোখের ছানি, পানিশূন্যতাসহ বিবিধ শারীরিক সমস্যা। বর্তমান সময়ে প্রবীণ ব্যক্তিদের সংকটের মধ্যে একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা ও বিষণ্নতা উল্লেখযোগ্য। যার সামাজিক কারণ যৌথ পরিবারের অবসান, একক পরিবারের আধিপত্য, অধিক হারে নারীর কর্মসংস্থান, উচ্চশিক্ষা বা কর্মসংস্থানের জন্য সন্তানদের বিদেশ গমন ইত্যাদি।
২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহ গণনা তথ্যমতে, দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯, যা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। জনসংখ্যাবিদদের ধারণা, ২০৫০ সালে দেশে প্রবীণের সংখ্যা হবে ৪.৫০ কোটি। সেই সময় প্রবীণ সংখ্যা হবে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। কোনো দেশের প্রবীণ সংখ্যা যদি মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ হয়, তবে ওই দেশকে বার্ধক্য জনসংখ্যার দেশ বলা হয়।
এ হিসাবে বাংলাদেশ এখন বার্ধক্য জনসংখ্যার দ্বারপ্রান্তে। ১৯৭১ সালে দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল পুরুষদের ৪১ বছর এবং নারীদের ৪৩ বছর। ২০২৪ সালে পুরুষদের গড় আয়ু ৭১ বছর এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৭৩ বছরে পৌঁছেছে। ধারণা করা হচ্ছে, অচিরেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বাংলাদেশের গড় আয়ু ৮০ বছরে উপনীত হবে।
দেশের বর্তমান চিকিৎসা ব্যবস্থা নিরাময়কেন্দ্রিক। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বার্ধক্যের পরিচর্যা, চিকিৎসা ও সেবায় পরিবর্তন আবশ্যক। বার্ধক্য নিজেই একটা নিরাময়-অযোগ্য ব্যাধি। জরাগ্রস্ততা নিজেই একটা অসুখ। তাই বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রবীণ সেবা ও সুরক্ষা সুনিশ্চিতকরণে প্রবীণ পরিচর্যা বা কেয়ারগিভার সিস্টেম জোরদার করা প্রয়োজন। আধুনিক প্রবীণ চিকিৎসাসেবা হিসেবে প্যালিয়াটিভ কেয়ার ব্যবস্থা ও জেরিয়াট্রিক মেডিসিন চালু করতে হবে। মমতাময় সমাজ প্রতিষ্ঠা বর্তমান জনস্বাস্থ্যের অন্যতম তত্ত্ব। যার মূল কথা হচ্ছে– নিজেকে প্রবীণ সেবায় নিবেদিত হতে হবে, যা দেখে নিজ সন্তান ও নবীনরা ভবিষ্যৎ প্রবীণ সেবায় নিয়োজিত হবে। বর্তমান প্রজন্মকে যদি প্রবীণ সেবার গুরুত্ব বা দীক্ষা প্রদান করা যায়, তবে নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎ প্রবীণবান্ধব সমাজ গঠন সম্ভব।
আজ ১ অক্টোবর, বিশ্ব প্রবীণ দিবস। সারাবিশ্বে প্রবীণ ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও প্রবীণবিষয়ক সচেতনতা জোরদারকরণের লক্ষ্যে প্রতিবছর এ দিবস পালিত হয়।
এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য– ‘মর্যাদাপূর্ণ বার্ধক্য: বিশ্বব্যাপী প্রবীণ পরিচর্যা ও সহায়তা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ’। বার্ধক্য মানবজীবনের এক নির্মম বাস্তবতা। যারা আজ প্রবীণ এবং বার্ধক্যে উপনীত, তারাই বর্তমান আধুনিক সমাজের রূপকার। তাদের উৎসর্গিত জীবনের চরম সুবিধাভোগী বর্তমান সমাজ। আসুন, প্রবীণদের সেবা ও পরিচর্যায় সম্মিলিতভাবে কাজ করি। প্রবীণবান্ধব সমাজ গড়ে তুলি। প্রবীণবান্ধব সমাজ গঠন হোক আমাদের অঙ্গীকার।
সহযোগিতায়: বাংলাদেশ প্রবীণ হিতৈষী সংঘ ও স্বেচ্ছাসেবী সমাজ কল্যাণ সংগঠনসমূহ, জামালপুর।