মোঃ সুজন আহমেদ বেনাপোল প্রতিনিধি
হামিদুল হক শাহীন যশোরের মাইকেল মধুসূদন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। শিক্ষা জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে নিজের জন্মস্থানে শিক্ষকতার পেশায় ফিরে লক্ষ্য করেন এখানকার বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে। সঙ্গে ইংরেজিতে দারুণ ভীতি। নিজের শহরের শিক্ষার্থীদের এই ভীতিকর অবস্থা থেকে উত্তরণে দায়বদ্ধতা অনুভব করেন হামিদুল।
শিক্ষক মাত্রই শেখাবেন, পড়াবেন। তবে হামিদুল এই দায়বদ্ধতা মেটালেন একটু ভিন্ন ভাবে। গড়ে তুললেন একটি সংগঠন—ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট, এডুকেশন অ্যান্ড অ্যাচিভমেন্ট (আইডিয়া)। এই সংগঠন শিক্ষার্থীদেরকে আত্মপ্রত্যয়ী করে তোলে। সঙ্গে সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সেচ্ছাসেবার মানসিকতা জাগ্রত করে। সংগঠনের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি ভীতি দূর করতেও কাজ শুরু করলেন হামিদুল। প্রথমত তিনি বোঝার চেষ্টা করলেন শিক্ষাজীবনের একটা বড় অংশে ইংরেজিতে পড়াশোনা করেও কেন শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে কথা বলতে পটু নয়। কেন ছোট থেকেই তাদের মাঝে ইংরেজি শেখায় অনীহা তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘ গবেষণার পর ইংরেজিকে সহজে আয়ত্তে আনার কিছু কৌশল তৈরি করলেন হামিদুল। নাম দিলেন খেলতে খেলতে শেখা।
হামিদুলের এই কৌশলে গানের মাধ্যমে, গেম খেলার মাধ্যমে ইংরেজি শেখা উপভোগ করবে শিক্ষার্থীরা। কৌশলটির সার্থকতা যাচাইয়ে ২০১৫ সালে ৪০জন শিক্ষার্থীর একটি টিমকে পড়ালেন হামিদুল। ৪ মাস পরে দেখা গেলো তারা খুব সাবলীল ভাবে ইংরেজিতে পড়তে ও লিখতে পারছে। এরপর টানা কয়েক বছর এভাবেই গ্রুপ করে নিজের কৌশলে কয়েক শতাধিক শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শিখিয়েছেন হামিদুল। কোচিং বাণিজ্যের রমরমা ব্যবসা যখন গোটা দেশে ছেয়ে গেছে তখন হামিদুল এই শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছেন আক্ষরিক মূল্যে। প্রতি ব্যাচ থেকে প্রাপ্ত অর্থের পুরোটাই সেই ব্যাচের শিক্ষার্থীদের হাত দিয়ে বিলিয়েছেন সামাজিক উন্নয়নে। কোথাও গাছ লাগিয়েছেন, কখনো ঠাঁইহীন মানুষের ঘর তৈরি করেছেন, শীতার্তদের কম্বল বিলিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাসেবার মানুষিকতা গড়ে তুলতে পুরোটাই করিয়েছেন তাদের তত্ত্বাবধানে। ছায়া হয়ে পাশে থেকেছেন শিক্ষক হামিদুল।
হামিদুলের ইংরেজি শেখানোর কৌশলটি ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। শিক্ষার্থীদের দারুণ সাড়া মিলছিলো। অনেকেই টানা দুই-তিন কোর্সে পড়েছেন হামিদুলের কাছে। কোর্স শেষে হয়ে উঠেছেন ইংরেজির জাহাজ। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ডাক পড়ে হামিদুলের। তখনকার যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান জানান শহরের দশটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১০০০ শিক্ষার্থীকে সামিতের মাধ্যমে ইংরেজি শেখাতে হবে হামিদুলকে। গতবছরের ১০ জুন ‘স্মার্ট যশোর ফর স্মার্ট বাংলাদেশ’ শিরোনামে হামিদুলের আইডিয়া স্পোকেন দ্য গেম মেথড-এর আয়োজনে যশোরের ৮টি স্কুল ও ২টি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে শুরু হয় সামিত। সামিতের নাম দেওয়া হয় ‘ইংলিশ অ্যাজ এ সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ (ইএসএল)’।
ছয় মাস ব্যাপ্তির এই সামিত শেষে শিক্ষার্থীদেরকে আরো বেশি উদ্বুদ্ধ করতে আয়োজন করা হয় একটি প্রতীকী সমাবর্তন অনুষ্ঠান। যেখানে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য, যশোর জেলা প্রাশসকসহ মান্যবর ব্যক্তিত্বগণ। সমাবর্তনের দিন দেখা যায় ছ’মাস আগেও স্কুলের যেসব শিক্ষার্থীরা ইংরেজিতে দু-একটি বাক্য বলতেই ঘাবড়ে যেতো তারাই অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলে যাচ্ছে, বক্তৃতা-প্রজেন্টেশন দিচ্ছে। কী সাবলীল ভঙ্গিতে বিতর্কের মঞ্চে ইংরেজির তর্ক যুদ্ধ করছে!
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় হামিদুল বলেন, ‘ইংরেজিকে সহজে শেখাতে গিয়ে দেখলাম বাচ্চারা খেলতে ভালোবাসে। তাই চেষ্টা করি গ্রামারের কনসেপ্ট গুলো খেলার মাধ্যমে তাদের কাছে পৌঁছাতে দেবার। ফলে তারা সহজে আয়ত্ত করতে পারে এবং ভুলে যাওয়ার প্রবণতা কমে যায়। আইডিয়া স্পোকেন ম্যাথডে আমরা বাচ্চাদেরকে থিওরিটিক্যাল কম পড়াই। ছন্দে গানে শেখাই, গেম খেলাই।’ হামিদুল আরো বলেন, ‘আমি ইংরেজির শিক্ষক নয় বা ইংরেজিতে খুব বেশি পাণ্ডিত্য আমার নেই। আমি শুধু চেষ্টা করছি ইংরেজি শেখাকে প্রাণবন্ত করে তোলার। যশোরে পরীক্ষামূলক ভাবে একহাজার শিক্ষার্থীদেরকে আমরা ইংরেজিতে দক্ষ করে তুলতে ফলপ্রসূ হয়েছি। আমাদের ধারণাকে আরো বৃহৎ পরিসরে ছড়িয়ে দিতে পারলে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। তাই এই প্রতীকী সমবর্তনের আয়োজন’।
হামিদুলের জন্ম, বেড়া উঠা যশোর শহরে। যশোর জেলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। শিক্ষাকতা পেশায় যোগদানের পর ইউনিভার্সিটি অফ নটিংহাম থেকে নিয়েছেন একটি উচ্চতর ডিগ্রী।