ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার নাকাটি হাট শহীদ আব্দুল জব্বার উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে অনিয়মের ছড়াছড়ির অভিযোগ উঠেছে। সরকারি নিয়ম নীতি তোয়াক্কা না করেই দেওয়া হয়েছে নিয়োগ।
বিধি মোতাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি জাতীয় পত্রিকায় ও একটি স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। এ বিষয়ে পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক সহ বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগ বাণিজ্য এবং অনিয়মের কথা উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন ঐ বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক।
অভিযোগ সূত্র মতে, গত ২০ সেপ্টেম্বর বিদ্যালয়টিতে সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি জাতীয় দৈনিকে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ঐ বিদ্যালয়টির সিনিয়র শিক্ষক তৈয়বর রহমান, হায়দার আলী, মুকুল চন্দ্র সহ আরও কয়েকজন আবেদন করেন।
সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য করে গোপনে মাসুমা রসিদ নামে এক জুনিয়র শিক্ষককে নিয়োগ প্রদান করেন। নিয়োগ প্রক্রিয়া গোপন করতে এই তিন শিক্ষককে দেওয়া হয়নি প্রবেশপত্র। জানানো হয়, নি পরীক্ষা, কবে, কোথায় ও কী ভাবে হয়েছে।
জানা যায়, ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে ১৪ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন। ২০১০ সাল থেকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন নূরুল আমীন। এর সাথে ২০০৭ সাল থেকে বিগত ১৬ বছরে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পদে ছিলেন ২ নং — কোষারানীগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আজহারুল ইসলাম রাজা।
রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপটে সরকারি নিয়ম নীতিকে তোয়াক্কা না করেই সাবেক প্রধান শিক্ষক নূরুল আমীন সহ যোগসাজশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা থেকে শুরু করে ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম পরিণত হয়েছে, অনৈতিকতার তুঙ্গে। বিগত বছরে বিদ্যালয়ের ফান্ডে কয়েক দফায় টাকা জমা হলে সে টাকা তুলা হয়েছে যার নেই , কোন রেজুলেশন ও ব্যয়ের নির্দিষ্ট খাত। টাকা তুলে কি করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোন শিক্ষক অবগত নেই, এমন অভিযোগও রয়েছে।
প্রধান শিক্ষক নুরুল আমিন অবসরের আগেই সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে ২০/০৯/২০২৩ ইং তারিখে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেন জাতীয় মানবজমিন ও দিনাজপুরের পত্রালাপ পত্রিকায়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার পরেই যথাযথভাবে আবেদন করেন, ঐ বিদ্যালয়ের কয়েকজন সিনিয়র সহকারী শিক্ষক।
দীর্ঘ দিন পার হলেও আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া হয়নি প্রবেশপত্র। পরবর্তীতে ০১/০১/২০২৪ ইং তারিখে সকল শিক্ষক জানতে পারে ঐ বিদ্যালয়েরই সহকারী শিক্ষিকা মাসুমা রশিদ সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। কখন, কিভাবে হলো এ বিষয়ে সবার ভিতরে গভীর ধোঁয়াশা। তথ্য মতে, নিয়োগ পরীক্ষার নিয়োগ কমিটি গঠন ও পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে রেজুলেশনে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক মাসুমা রশিদ নিজেই শিক্ষক প্রতিনিধি হিসেবে স্বাক্ষর করেন, এবং গত ৭ জানুয়ারি অনুমোদনের সেই সভায় তিনি উপস্থিত স্বাক্ষর করেন।
কিন্তু সেই দিন ১২ তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার পদে তিনি নির্বাচনী দায়িত্বে থাকাকালীন ঐদিনই কিভাবে সভায় উপস্থিত থেকে স্বাক্ষর করেন, এ নিয়ে রয়ে গেছে , শুধুই ধোঁয়াশা। আবার ০১/০১/২০২৪ ইং তারিখে মাসুমা রশিদ নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পরেও জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে হাজিরা খাতায় সহকারী শিক্ষক হিসেবেই স্বাক্ষর করেছেন।
অন্যদিকে ঐ পদের বলেই তুলেছেন বেতন। অনিয়ম নিয়ে সাবেক প্রধান শিক্ষক নূরুল আমীনের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে গড়িমসি করে নিয়োগ প্রক্রিয়া বৈধ হয়েছে বলে, দাবি করেন। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক সভাপতি আজহারুল ইসলাম রাজা পলাতক থাকায় তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। বিষয়টি নিয়ে পীরগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আরিফুল্লাহ্ এর সাথে কথা বললে, তিনি জানান, সাবেক প্রধান শিক্ষক নূরুল আমীন আগের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি বাতিল করে নতুনভাবে জাতীয় আজকের প্রত্যাশা এবং দিনাজপুরের একটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন।
তথ্যের সত্যতার জন্য পত্রিকার কপি দেখতে চাইলে তিনি দেখাতে পারেননি। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ঐ তারিখে দিনাজপুরের জনমত পত্রিকায় অত্র বিদ্যালয়ের কোন বিজ্ঞপ্তি নেই ! সাক্ষাৎকারে পীরগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার জানান, নিয়োগ পরীক্ষা নেকমরদ আলিমউদ্দিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে ,কিন্তু তিনি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত রিপোর্টে লিখেছেন, নিয়োগ পরীক্ষা অত্র বিদ্যালয়ে নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত ডিজি প্রতিনিধি আলিমউদ্দিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আখতার হোসেনের সাথে কথা বললে, তিনিও জানান, পরীক্ষা নাকাটি হাট শহীদ আব্দুল জব্বার উচ্চ বিদ্যালয়েই অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডিজি প্রতিনিধি নিয়োগের অফিস আদেশের নির্দেশনা গুলো সঠিকভাবে না মেনে নিজ খেয়াল খুশিমতো নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন তিনি।
শর্ত অনুযায়ী সকল আবেদন পত্র, বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পত্রিকার মূল কপি সহ যাবতীয় তথ্যাদি তার কাছে থাকার কথা লেখা থাকলেও তিনি কোন তথ্য দেখাতে পারেন নি। পরীক্ষার ফলাফল শীটে উল্লেখ নেই, ইনডেক্স নম্বর ও নিবন্ধন নম্বর। যেখানে মাসুমা রশিদের অভিজ্ঞতা দেখানো হয়, ১৩ বছর কিন্তু বাস্তবে অভিজ্ঞতা ১০ বছর ১১ মাস।
ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক বরাবরে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সরদার মোস্তফা শাহিন, নিয়োগ কার্যক্রমে অনিয়ম রয়েছে বলে, সরেজমিনে তদন্তের নির্দেশ দেন পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে। অন্যদিকে ঠাকুরগাঁও জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শাহীন আকতার জানান, অভিযোগ পেয়ে সরেজমিনে তদন্ত করা হয়েছে। তদন্ত চলমান রয়েছে, এখনো আমরা রিপোর্ট ফাইনাল করতে পারিনি। আশা করি অচিরেই এ বিষয়ে সুষ্ঠু সমাধান হবে।